ইয়াবার ফ্লেভার মিশিয়ে বিক্রি করছে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ব্যথার ট্যাবলেট

ইয়াবার ফ্লেভার মিশিয়ে বিক্রি করছে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ব্যথার ট্যাবলেট

চোরাই পথে ঢুকছে ইয়াবার উপকরণ। ১০ হাজার ইয়াবা থেকে তৈরি হয়ে যায় এক লাখ নকল ইয়াবা। নাম সর্বস্ব ওষুধ কোম্পানি ইয়াবার আকৃতির ট্যাবলেট তৈরি করছে। তাতে ইয়াবার ফ্লেভার মিশিয়ে বিক্রি করছে একটি চক্র। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ব্যথার ট্যাবলেটও ব্যবহার হচ্ছে ইয়াবার ফ্লেভার 

আলো-আঁধারি পরিবেশে বিক্রি হচ্ছে। আর সেবনও একইভাবে। ক্রেতার যেমন শঙ্কা, তেমন আতঙ্ক বিক্রেতারও। এই শঙ্কা-আতঙ্কের লুকোচুরির মধ্যেই মাদকসেবীর হাতে গুজে দেওয়া হয় ইয়াবা ট্যাবলেট। নেই পরখ করার সুযোগ। ফেন্সিডিল আর গাঁজার কেনা বেচাও একইভাবে। ক্রেতা পুলিশের ঝামেলা এড়াতে দ্রুতই কেটে পড়েন। ফিরে যান নিজস্ব মাদক সেবনের আসরে। একের পর এক ইয়াবা সেবন চলছে, নেশা ধরে না। একটার পর একটা ফেন্সিডিলের বোতল খালি করছেন। তাও নেশা লাগছে না। এবার সিগারেটের আদলে তৈরি গাঁজায় টান দিয়েও মন ভরে না। শেষে গাঁজার কলকিতে টান। তাও সুখ নেই। আসলে নেশাটাই বা ধরবে কিসে। সবইতো নকল। নেশায়ও যে ভেজাল! মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, ঢাকাসহ সারা দেশে মাদকসেবীদের কাছে এ মুহূর্তে বেশি চাহিদা হচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেট। এরপর গাঁজা আর ফেন্সিডিল। এসব মাদকদ্রব্যই এখন নকল। আর আসল ভেবেই তা কিনে নিচ্ছে মাদকসেবীরা। সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় একাধিক মাদক ব্যবসায়ীর। অনেক কথার মাঝে তারা জানালেন, এক সময়ে আসল ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যেত। যার দুটো ইয়াবা সেবন করলেই নেশায় হাবুডুবু করতো। কিন্তু ইয়াবা ডন আমিন হুদা গ্রেপ্তর হবার পর থেকে সেই ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায় না। যদিও মেলে তার প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম পড়বে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কিন্তু এতটাকা দিয়ে সবাই মাদক নিতে পারে না। এখন যে ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেট মেলে তার ১০টিতেও নেশা ধরে না। ইয়াবার ডিলাররা চাহিদা ও ক্রেতার দিকে বিবেচনায় রেখে সস্তায় ট্যাবলেট সরবরাহ করছে। যেগুলো নকল। তাতে তেমন নেশার উপাদান নেই। এদিকে গাঁজায়ও নকল।
প্রসঙ্গে এক ব্যবসায়ী বলেন, গাঁজায় ভেজাল মেশানো হচ্ছে। তিনি জানান, গাঁজা পাতার সাথে অন্য কোন গাছের পাতা গুড়ো করে ভাতের মাড় দিয়ে মেশানো হয়। পরে সেগুলো পুরিয়া আকারে বিক্রি করা হয়। আর ফেন্সিডিলতো অরিজিন্যাল মিলে না। এর পুরোটাই ভেজাল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, গত এক বছরে (২০১৭ সালে) মাদক সংক্রান্ত ৬৪ হাজার মামলার জব্দকৃত মাদকের রাসায়নিক পরীক্ষায় মাদকের উপকরণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ইয়াবা। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় রাসায়নিক পরীক্ষাতেও উদ্ধার করা বেশিরভাগ ইয়াবায় মূল উপাদান পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ইয়াবা সাধারণত আলো আঁধারি পরিবেশে বিক্রি হয়। খুচরা বিক্রেতা হয়তো ছোট একটি পলিথিনে মুড়িয়ে কয়েক পিস ইয়াবা ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দেয়। ওই পরিবেশে ক্রেতা আসল নকল যাচাই করার সুযোগ পায় না। ইয়াবা নকল হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, আসলে প্রথম দিকে ইয়াবায় যে ধরনের কার্যক্ষমতা ছিলো, এখনবেশিরভাগ ইয়াবায় এর অর্ধেকও নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির ৩৮তম সভায় ইয়াবার কাঁচামাল (বিভিন্ন ধরনের উপাদান) বাংলাদেশে আমদানি ও এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ী চক্র ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। তারা মিয়ানমার থেকে গোপন পথে আনা ইয়াবা ট্যাবলেট সরাসরি ক্রেতার হাতে দেয় না। ধরুন ১০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট মেশিনের সাহায্যে গুড়া করে। ওই গুড়োর ভেতর আরও পাউডার জাতীয় উপাদান মেশায়। পরে পিলিং মেশিনের সাহায্যে বড়ি বানানো হয়। মূল ১০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট তখন ১ লাখে উন্নীত হয়। তিনি জানান, এ কাজের জন্য চক্রের সদস্যরা ঢাকার আশপাশে এভাবে ছোট ছোট কিচেন ল্যাব গড়ে তুলেছে। ডেমরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকাতে এ ধরনের ৭টি ল্যাবের সন্ধান পেয়ে সেখানে অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমদানি নিষিদ্ধ হলেও চোরাই পথে ইয়াবার উপাদান দেশে আসছে কিনা জানতে চাইলে দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ডিমান্ড থাকলে সে জিনিসের কোনো না কোনোভাবে সাপ্লাই হবেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চায়না থেকে এগুলো চোরাই পথে আসতে পারে। তিনি বলেন, মাদকের ভয়াল গ্রাসে দেশ-জাতি আজ ধ্বংস হতে বসেছে। কাজেই যে কোনো ধরনের মাদকের উপকরণ দেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সকলকে সজাগ থাকতে হবে। ইয়াবা ছাড়া ফেনসিডিলও এখন নকল হচ্ছে। পুলিশের মাদকদ্রব্য উদ্ধার টিমের এক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই বেশ কয়েকটি নকল ইয়াবা কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে আবদুল্লাহ জুবায়ের নামে মিয়ানমারের এক নাগরিক ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিল। তবে উৎপাদনের আগেই জুবায়ের ডিবি পুলিশের হাতে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা, পাজারো গাড়ি, ইয়াবা তৈরির মেশিনসহ গ্রেপ্তার হয়। এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েকটি নকল ইয়াবা তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। গত বছর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল, সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার হয় কারখানার মালিক আলী আকবর। তিনি পুলিশকে জানান, শুরুতে ওষুধের নকল কারখানা স্থাপন করলেও চাহিদা এবং লাভ বেশি হওয়ায় ইয়াবা উৎপাদন করে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করে আসছিল সে। এর আগে মধ্যবাসাবো এলাকায় ইয়াবা তৈরির নকল কারখানার সন্ধান পায় পুলিশ। বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া নকল ইয়াবা কারখানার মালিকদের দেওয়া তথ্য মতে, নকল ইয়াবা তৈরির জন্য তারা সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন ও ভেনিলার পাউডার ব্যবহার করে থাকে। কতিপয় ছোট আকারের ওষুধ কোম্পানি ইয়াবার আকৃতির ট্যাবলেট তৈরি করছে। সেই ট্যাবলেটগুলো নকল ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কিনে তাতে ইয়াবার ফ্লেভার মিশিয়ে তা বিক্রি করে। এসব নকল ইয়াবা পরিচিত ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হয় অল্প টাকায়। আর মিয়ানমার থেকে আনা এক পিস ইয়াবার পাইকারি দাম কয়েকগুণ বেশি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালক জানান, ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান মিথাইল অ্যামফিটামিন ও ক্যাফেইন। একটি ট্যাবলেটে ৩০ থেকে ৩৫ মাত্রার মিথাইল অ্যামফিটামিন এবং বাকিটা ক্যাফেইন। তবে দেশে আটক বেশিরভাগ ইয়াবার ক্ষেত্রে সে পরিমাণ উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ইয়াবাসেবী বা বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলাও টিকে না। রাসায়নিক পরীক্ষাগারের রিপোর্টে যখন বলা হয়, এতে ইয়াবার উপাদানের উপস্থিতি নেই বা কম, তখন মামলার মেরিট আর থাকে না। তিনি জানান, ঢাকায় লাখ লাখ ইয়াবাসেবীর একটা বড় অংশ নকল ইয়াবা ব্যবহার করছে।
পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান নানা হাত হয়ে ঢাকায় আসে। খরচ বাঁচাতেই নকল ইয়াবা কারখানা দেওয়ার চেষ্টা করছে ইয়াবা ব্যবসায়ীচক্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবার মতো ভয়ঙ্কর মাদক তৈরির উপাদান যাতে কোনোভাবে দেশে ঢুকতে না পারে সেদিকে কড়া নজরদারি বাড়ানো উচিত।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment